চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল | শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলা কি বাঙালী ছিলেন? তিনি কি বাংলা জানতেন? তিনি কোন ভাষায় কথা বলতেন? অনেকে হয়তো বলবেন ফার্সী, অনেক বলবেন উর্দু। নবাবী আমলে রাজকার্য চলতো ফার্সী ভাষায়। এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু নবাবদের পারিবারিক ভাষা কি ছিল? মাত্র পৌনে তিন’শ বছর আগের ব্যাপার। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সে সময় ফার্সী ভাষা (ইরানী ভাষা) ছিল অভিজাত শ্রেণীর ভাষা। এখন যেমন ইংরেজী। কিন্তু সবার মাতৃভাষা বা পারিবারিক ভাষা নিশ্চয় ফার্সী ভাষা ছিল না। যেমন দিল্লীর সম্রাট বাবর, বা বখতিয়ার খিলজীর ভাষা ছিল তুর্কী। কিন্তু তারা রাজকার্য পরিচালনায় তুর্কী ব্যবহার করতেন না। তারা ব্যবহার করেছেন ফার্সী।
একটি তথ্য থেকে জানা যায় সিরাজ উদ দৌলার পূর্বপুরুষরা আরব থেকে এসেছিলেন। সে হিসেবে তাদের ভাষা হওয়ার কথা আরবী। কিন্তু আরবী ভাষা তার প্রজন্ম পর্যন্ত তাদের পারিবারিক ভাষা ছিল কিনা বলা যায় না। সিরাজ উদ দৌলাকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে যতটা জানতে পেরেছি তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। তবে তাদের উর্দু সম্ভবত এখনকার মত পরিশীলিত উর্দু ছিল না। আগেই বলেছি সে সময় রাজকার্যের ভাষা ছিল ফার্সী কিন্তু এই ভাষা সাধারন মানুষের বোধগম্য ছিল না। শিক্ষিত ও অভিজাত শ্রেনীর লোকজন এই ভাষাটা জানতো। সাধারন জনগন কথা বলতো বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায়। এগুলিকে বলা হয় হিন্দভি। এই ভাষা একেক জায়গায় একেক রকম ছিল। এই ভাষার নির্দিষ্ট কোন ব্যাকরণ ছিল না। ফার্সীর সাথে সাধারন মানুষের ভাষার যোগসূত্র তৈরী করার জন্য লিঙ্ক ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে উর্দু ভাষার উদ্ভব হয়। এতে প্রচুর স্থানীয়, আরবী ও ফার্সী শব্দ থাকায় এটি সবার জন্য তুলনামূলকভাবে সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। এই ভাষাটি মূলত আরবী হরফে নাস্তালিক পদ্ধতিতে লিখা হয়। নবাব সিরাজ উদ দৌলার উর্দু সম্ভবত তখনকার উর্দু ও স্থানীয় ভাষার মিশেলে অন্যরকম এক উর্দু ছিল।
যাই হোক ইংরেজ সরকার ১৮৩৭ সালে ফার্সী ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে সরকারী ভাষা হিসেবে অনুমোদন দেয়। যেহেতু উর্দুতে আরবী ও ফার্সী শব্দের আধিক্য ছিল, উর্দুতে এরপর প্রচুর সংস্কৃত ও অন্যান্য স্থানীয় শব্দের সম্মিলন ঘটিয়ে ও দেবনগরী হরফে লিখে এটিকে আরও ভারতীয়করন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এটিই হচ্ছে আজকের হিন্দী ভাষা। পরবর্তীতে হিন্দীও সরকারী সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ দুটি ভাষাকে তখন বলা হতো হিন্দুস্তানী ভাষা। দুটি ভাষারই উৎস এক। দুধ থেকে যেমন মাখন ও ঘি উভয়ই তৈরী হয়। উর্দু ও হিন্দী উভয়ই এসেছে প্রাকৃত থেকে।
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভারত হিন্দিকে ও পাকিস্তান উর্দুকে রাস্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করে। তখন এই দুটি ভাষা কোন দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল না। ভারতে হিন্দী নিয়ে কিছু অসন্তোষ ও বিতর্ক থাকলেও রাষ্ট্রীয় ঐক্যের স্বার্থে একপর্যায়ে সবাই তা মেনে নেয়। সমস্যা হয় পাকিস্তানে। উর্দু তখন পাকিস্তানের কোন অংশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল না (সম্ভবত এখনও নয়)। পাকিস্তানে তখন উর্দু ভাষায় পাচ শতাংশেরও কম লোক কথা বলতো। কিন্তু ভৌগলিক দূরত্বের জন্য পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল না। পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মানুষ অথাৎ বর্তমান বাংলাদেশের জনগন মনে করে উর্দুকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পশ্চিমাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের এই সিদ্ধান্ত মনে হয় দুরভিসন্ধিমূলক ছিলনা। তখন পুরো ভারতবর্ষে হিন্দী ও উর্দু ছাড়া আর কোন ভাষা ছিলনা যা সবাই বুঝেতে পারতো (এবং এখনও নেই)। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বোঝানা হয় উর্দু রাস্ট্রভাষা হলে তারা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারবে না। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ – এ জাতীয় গান গনঅসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু ব্যাপারটা মুখের ভাষা নিয়ে ছিল না, ছিল সরকারী বা দাপ্তরিক ভাষা নিয়ে। ঘটনা যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাস্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা একমাত্র রাস্টভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও কর্মক্ষেত্রে এর প্রয়োগ অনেক কম। গত পঞ্চাশ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাভাষায় যে উৎকর্ষতা আসা উচিত ছিল তা হয়নি। বাংলা ভাষা আরো সহজ ও যুগোপযোগী করে তোলার ব্যাপারে ভাষাবিদদের গবেষনা তেমন চোখে পড়ে না। চাকুরী, ব্যাবসা, উচ্চশিক্ষা কোন কিছুই ইংরেজী ছাড়া বাংলাদেশে সম্ভব নয়। একুশে ফেব্রুয়ারী এলে বাংলা ভাষা ভিত্তিক কিছু আলোচনা হয় বটে, কিন্তু ওগুলো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইংরেজীতেও যে আমাদের প্রচুর দক্ষতা এসেছে তা নয়। দেশের বাইরে গেলে বোঝা যায় আমাদের ইংরেজী শিক্ষার মান। আমাদের স্কুলগুলিতে বাংলা পড়ানো হয়, কিন্তু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শেখানো হয় না। আমাদের সময় স্কুলে আমরা ছাত্ররা ও আমাদের শিক্ষকরা সবাই আঞ্চলিক ভাষায় যে যার মত কথা বলেছি। কোনদিন আমাদের শিক্ষকরা বলেননি যে শ্রেনীকক্ষে শুদ্ধবাংলা বলতে হবে।
পরবর্তীতে যতটুকু শুদ্ধ বাংলা শিখেছি অন্যকে দেখে নিজের চেস্টায় শিখেছি। যে জাতি নিজের ভাষা শুদ্ধ করে বলতে পারেনা তারা ভালো করে অন্য ভাষা শিখবে কি করে। সাধারন লোকের কথা বাদ দিলাম, আমাদের রাস্ট্রপতি আবদুল হামিদ, ইয়াজুদ্দিন বা শাহাবুদ্দিনরা যে বাংলা বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলরা শুনলে হয়তো কেদে ফেলতেন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি কাজ হয়েছে। হিন্দি শেখার নাম করে বাংলাদেশের মানুষ হিন্দু ও উর্দুটা ভালোই রপ্ত করেছে। যেহেতু বানিজ্যিক কারনে ভারতের হিন্দী সিনেমা, নাটক ও গানে প্রচুর উর্দু শব্দ ব্যবহার করা হয়, আমাদের তরুন প্রজন্মের এখন উর্দু বুঝতে কোন অসুবিধাই হয় না। ওরা এখন পাকিস্তান আমলের তরুনদের চেয়েও ভালো উর্দু বলতে পারে। তারা এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠেছে যে দেশে ও দেশের বাইরে ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের সাথে কথা বলতে ইংরেজীর চেয়ে উর্দুতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে (এমনকি আমেরিকাতেও)। অনেকে এজন্য ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে দায়ী করেন। হয়তো তাই। কিন্তু আমাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনা দরকার।
(বিঃদ্রঃ আমি ইতিহাসবিদ নই। আমি গবেষনা করিনি, অনুসন্ধান করেছি মাত্র। কেউ আমাদের আরও বেশী সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারলে উপকৃত হবো।)
Posted ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh